‘One must have a mind of winter
To regard the frost and the boughs’ — Wallace Stevens
১।।
এই
শীতে লেগে আছে চুলের গন্ধ ম্রিয়মান, ঝাপসা লন্ঠনের মত দমকা হাওয়ার ভিতর।
এই
শীতে পায়ের নিচে কোন মাটি নেই, ঘাস
নেই, নেই পাখিদের ঠোঁট।
কিছুতেই
মনে পড়ছে না তোমার নাম।
পায়ের
নিচে কোন ঘুম নেই, কোন
সকাল নেই। নেই স্নানের গন্ধ। জলের বদলে নেমে আসছে তপ্ত
নিঃশ্বাস। বালতির গভীরে দুলে উঠছে না কারো
ছায়া। জং ধরে যাওয়া শীতের
ল্যাং এ কোন তাপ নেই, নেই কিছু অপমান। আজ নেলপালিশের কোন মনখারাপ নেই। পায়ের আঙুলে কোন ভিড় বাস নেই, কলেজ স্ট্রীট নেই। কোন ঠেক নেই অফ পিরিয়ডে, নেই গড়িয়ার বাজারহাট। নির্দিষ্ট কোন দিন মনে পড়ছে না। আজ কি বুধবার? এখন কি গোধূলিবেলা? ছিটকে বেরিয়ে আসছি... ভুলে যাচ্ছি ভোর হওয়ার আগে। ভুলে যাচ্ছি কি ভুলে যাচ্ছি... গাঢ় সঙ্গম দিয়ে আর ঘিরে নেই তুমি... জিভে দগদগে ঘা।
২।।
গুহার
ভিতরে দেখা হল। সবাই বলছে- ‘ও তোমার শত্রু’। প্রতিটা
শীতে কী মানুষ এতটাই পালটায়! প্রকাণ্ড রোদে দেখি আর কিছুমাত্র অবশিষ্ট নেই।
পুরোটাই ভেঙ্গে চুরমার... হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস গুঁড়োগুঁড়ো একদম... আশ্চর্য! বাইরে কিভাবে ধরে রেখেছ এত নিপুন বিপক্ষশিবিরের হাসি,
অহংকার? মোজার ভিতরে কিভাবে পুষছো এত
জোঁক এতদিন?
৩।।
এই শীত
ফাটছে সাপের খোলসে। এই শীত থেঁতলে আছে
ব্যাঙের ঠ্যাঙ্গের নিচে রোদের অ্যাজমায়। রোদের
নিচে আরো নিচু স্বরে ক্রমাগত জ্বরের সাথে ইশারায় কথা বলি।
তারপর ধসে
পড়া একটা পোড়ো বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেছি। পোড়ো বাড়ির ভিতরে একটা তেল চিটচিটে সুতোর মত
সরু সুড়ঙ্গে আমাদের কচ্ছপীয় জীবনশৈলী... লেপ্টে আছি যুক্তাক্ষরের মত,
আমরা
একে অপরের ভিতরে অনুজাত
আমরা
একে অপরের ভিতরে অনুবন্ধ,
তবুও
কিছুতেই মনে পড়ছে না তোমার নাম।
৪।।
বিকট
চিৎকারে মাঝরাতে ঘুম ভাঙ্গে। অনেকগুলো লোক শাবল নিয়ে মাটি খুঁড়ছে
আমারই
বুকের ভিতরে। চিলচিৎকার। দানবীয় জন্তুর দল ধাতব
চোখে তাকিয়ে আছে। মনি নেই। কোটরহীন সাদা নির্লিপ্ত দৃষ্টি। হাড়ে ঠং ঠং শব্দ। নোংরা
হাতে মাটি সরায়।
তারপর
এক তীব্র বিস্ফোরণ। ব্রহ্মতালু ছিঁড়ে যায়! ও! এর ওর মাথায় ছিটকে পড়ছে লাশ। সারা
শরীর এখন কবরখানা। মাথায় ঘাস-ওলটানো চাঙড়। সারা শরীরে, শহরে, গ্রামে গঞ্জে এখন
লাশের মহৎসব। এর ওর মাথায় শুধু ছিটকে পড়ছে লাশ। লাশ। লাশ।
বড়
সুসময় আজ পরিসংখ্যানবিদদের, লাশের
ভিড়ে লাশ গুনছে লাশ...
এবার
পলাশের বদলে গাছে গাছে ঝুলবে কাটা মুন্ডু। হাড়গোড়
মাটি চাপা দিচ্ছে আমাদেরকে... তারপর
সেঁধিয়ে যাচ্ছে রেস্তোঁরায়, চপ কাটলেট, চাউমিন বিরিয়ানির
ভিতরে। অশ্বত্থ গাছের ঝুরিগুলো দুলছে
অন্ধকারে, আড়াল থেকে নেমে আসছে ছায়ামূর্তি। ক্যামেরায় শাটারের ওপর আঙুল নিয়ে প্রতীক্ষমান ভগবানদা। স্থিরচিত্রগুলো
আস্তে আস্তে চলচ্ছবি হয়ে উঠছে... সব
চরিত্র ফ্রেম থেকে বেরিয়ে যায় ধীরে ধীরে, আর আমি ক্রমশ ঢুকে যাই ফ্রেমের মধ্যে।
হে
একুশের প্রহর, অস্থির সমুদ্রের সামনে শুয়ে থাকা উদাসীন সিন্ধুঘোটক কে কেন দিলে এই
লাশপ্রাপ্তির সময়?
৫।।
ছাদে
মেলা ভেজা শাড়ী পেরিয়ে যায় ঘন্টাধ্বনি। বারান্দা থেকে নেমে আসে বীরুৎজাতীয় মনখারাপ। জানালাগুলো আমার একশ’ প্রেমিকার ঋতুরক্ত ছুঁয়ে ছুঁয়ে তলপেটে মুখ নামিয়ে নীরবতা পালন করে। চাঁদের ওড়না গলায় ফাঁস লাগিয়ে
ঝুলে পড়ে সিলিং থেকে নীলবিষণ্ণতা।
শিরীষের
পাতা ঝরছে সিঁদুর লাগানো পাথরের ওপর। রমণীরা
গাঢ় দুধ ঝরিয়ে আসে শিবলিঙ্গের মাথায়। আবার
গর্ভবতী হয়ে পড়ে পার্বতী। কলেজের পর টিউশন পড়তে গিয়ে আর বাড়ি ফেরেনি পার্বতী। পাঁচিলের পাশে ছড়িয়ে
ছিটিয়ে আছে ওর বই খাতা, ভোলার দোকান থেকে কেনা
দুটাকার চুলের ফিতে, টেস্টের মার্কস। ঠ্যাং
ভাঙ্গা ‘দ’এর মত শুয়ে আছে পার্বতী ও শ্রেণীসংগ্রাম। সিরিয়াল থেকে মুখ তুলে একবার ঠাকুর দেখে যায় মেয়ে-বউরা।
শিলনোড়ার
পাশে ভিজে চালগুঁড়ি, পার্বতীর
মা, উড়ো খবর, ধর্ষিতা মেয়ের গায়ের অকাল পৌষসংক্রান্তিকাল।
৬।।
বিষণ্ণতা
ছুঁয়েছে রোদ।
আলেয়ার
মত মরা ভুঁইফোড় মাজরাপোকার পুড়ে যাওয়া ক্ষীণতম ছায়া।
গবাদি
পশুর ব্যাপক বাঁটের পাশে রুগ্ন রোগাক্রান্ত শিশু।
একটা
দানো জিওল মাছের কম্পমান কাটামুন্ডুর অভিশাপে কাঁপছে ফসলহীন
ল ন্ড
ভ ন্ড বসতবাড়ি।
লকলকে
রোদের জিভ থেকে ঝরে অবিরাম জাবরের ক্ষুধামান্দ্য-জল।
রোদের ঠোঁটচিহ্নে আঙুল ছুঁয়ে বিষণ্ণতার যাবজ্জীবন অসুখ।
যেমন
বিদ্রূপ সয়ে সয়ে সঙ্গম-
শেষে
ভাদ্রের রোদে আটকে থাকে
কুকুর কুকুরীর মিলন অঙ্গ
তেমন
আছি তুমি আমি,
আমি আর
বিষণ্ণতা,
৭।।
তাহলে
কি অনিবার্য এই পরাজয়?
সর্ষেক্ষেতের
ভিতর দিয়ে এই হাঁটা, সূর্যাস্তের
রঙে ঝুলে থাকা বাদুড়ের ডানা,
পায়ে
জলপোকাদের কামড়ের এই দীর্ঘ মাঘমাস?
জোনাকির
নিভে যাওয়ার মুহূর্তে গোপনে বাদ দিয়েছি অনেক বান্ধবীকে
অপেক্ষা
করছি সেই বিশেষ ঘরের জন্য। পাতাল
ফুঁড়ে ওঠা সেই মন্থনমুহূর্ত।
একের
পর একে প্যাঁচে ফেলছি ইনসমনিয়াকে। ইনসমনিয়া গম্ভীর মুখে বলেছে- ‘এখন এরকমই হয়’। গায়ের ওপর উঠে আসছে সরসরে ডেয়ো পিঁপড়ে। মাংসগুলো
খুলে খলবল করে ঝুলছে গাল থেকে। পাঁজরে ভুয়ো পালিশের চটাফাটা কালো রঙ। এই আদিম গুমঘরের ভিতরে চুরি হয়ে
আছে
ভাপসা আবছায়া দলা পাকানো গন্ধ জুতোর
শবাসনে। তবু সেকেন্ড থেকে এক মুহূর্ত মুখ তুলিনি, সৎ
থেকেছি পায়ের কাছে বসে।
একে
অপরের ভিতরে সমোচ্চারিত
একে
অপরের ভিতরে সমদর্শী
তবু কি
অনিবার্য এই পরাজয়?
টেনে
নামাচ্ছ আমাকে। নিচু
জলাভূমিতে কচুপাতার ওপরে জলের মাগনিফ্যাইং
গ্লাসে
আমাকে
প্রসারিত করতে করতে
কেমন
খেলা শিখে গেছ খেলার ভিতরে!
৮।।
ভ্রু’র
নিচে অনেকগুলো চাকা গড়িয়ে নামছে। বাতাসে
পতপত করে দুলছে সরু কোমর লাউডগা সাপের মত। চোখে শিকারের নেশা। আমি হাতের তালুতে পিষে মেরে ফেলছি কয়েকটা কামড়। তবু আর কোনভাবে জাগছি না তোমার
লেহনের শব্দে শুধু জেগে উঠছে চরাচর। নোনতা গন্ধে মুখ তুলছে ঘোঁতঘোঁত শব্দ। গা-খুলে
উঠে বসছ দেওয়ালের উপর, তবু
আমার দেওয়াল জাগছে না আর কোনভাবে। মসের
ব্যর্থতা বুক পেতে নিচ্ছ। রাগে
ঘৃণায় ভেঙ্গে দিচ্ছ আমার ঘুম, মেরুদণ্ড, দণ্ডমেরু... এইভাবে আমরা শুকনো রক্তের আঁশ চিনে চিনে প্রতিশ্রুতিহীন প্রহরে শীতের অক্ষরকে খুলে খুলে... খুলে খুলে...খুলে...
তবু
মনে পড়ছে না...মনে...
(চিত্রঋণ : অঁরি তুলুজ লত্রেক)
আমাকে অবাক করলো ৮পর্বের দীর্ঘ কবিতা !
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।
ReplyDelete