বেশ কিছুদিন আগে,
‘দি ক্রাফট অফ পোয়েট্রি’ নামে সাক্ষাৎকার-সংকলনে আরো অনেকের সঙ্গে অডেনেরও একটি
কথামালা পড়েছিলাম। অনেক দুর্মূল্য শব্দ ছিল সে-চর্যায়, সব মনে নেই, কিন্তু তার
মধ্যে একটি আজও আয়ত্বে আছেঃ কবির পক্ষে তাঁর লেখা কোনো কবিতা ভাল কি খারাপ সে-কথা
বলা খুব মুশকিল, তিনি বরং জানতে পারেন সে-লেখাটি সৎ কিনা, আদৌ তাঁর লেখা কিনা।
লেখালেখি প্রসঙ্গে এই কথাটির মানে অনেক। এমন অনেক কবিতাই হয়, যা বাইরে থেকে তির্যক
ও সচ্ছল, কিন্তু ভেতরে ঝুটো। সমর্থ কবিও, বুঝে বা না-বুঝেও হয়তো বা, কখনো লিখে
ফেলেন এমন অনেক কিছুই, যা আদতে তাঁর লেখা নয়, তাঁর অনুভবের সায় নেই তাতে। যে সুধীর
দেশান্তর থেকে যাত্রা শুরু কবিতার, তার অনেক এপারে ঐ সব ফালতু অক্ষর।
যে-কোনো সময়ই, এ তথ্য সাহিত্যে সত্য হতে
পারে। বাংলা সাহিত্যের বয়স হাজারের মধ্যেই, চর্যাপদ যদি বাংলায়, অন্তত মেশানো
বাংলায়ও লেখা হয়েছে ধরি, তাহলেও ঐ হাজারের এদিক-ওদিক। লিখিত সাহিত্য তো আছেই,
কিন্তু মুখে মুখেও অনেক ছড়া-কবিতা-গান রচিত হয়েছে, হারিয়ে গেছে অনেকটাই। যা পাওয়া
গেছে, তাতেও মিশেছে বহু হাতের পছন্দ। আহমদ শরীফ ‘লোকসাহিত্যের’ একটি আসরে উষ্মা
জানিয়েছেন ঠিক কারণেই হয়তো, এবং আর একজন লালন ফকির নয়, রবীন্দ্রনাথই আমাদের চাই,
বলেছেন তাও, কিন্তু কবির যে আমর্ম সততার কথা বলেছেন অডেন, মুখে-মুখে হওয়া ঐ সব
লেখালাখিতেই খুঁজে পাওয়া যাবে কিন্তু, বরং, তার খোঁজ পাওয়া যাবে বেশি। লেখায় সচেতন
ইচ্ছে-অনিচ্ছে-উদ্দেশ্য অনুষঙ্গ হয়ে থাকে। মুখের সৃষ্টিতে, পুরোটাই অনুভবের ঢল
থাকায় তার নির্ভরযোগ্যতা বেশি।
সব মিলিয়ে বাংলা সাহিত্যের লেখা বা না-লেখা
কয়েকটি প্রকরণ ছুঁয়ে ছুঁয়ে এই নির্ভরযোগ্যতায় নানা রকম টের পাওয়াই আমাদের লক্ষ্য।
চর্যাপদগুচ্ছ, কারও কারও মতে, মুখে মুখে বেঁচে থাকা রচনাই। অন্তত, বেশ কিছু সময়
ধরে ঐসব কবিতা যে উচ্চারিত ছিল তখনকার বাংলায়, তা বোঝাই যায়। লিপিবদ্ধ হয়েছে,
সে-লিপিও বাংলাই। তবে চর্যাপদকে লোকসাহিত্যের মধ্যে ফেলতে চান না প্রায় কেউই,
বোধহয় মহাযান বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ধর্মকথা চর্যায় বড় করে দেখানো হয়েছে বলেই। যদিও
সুকুমার সেন বুঝিয়েছেন যে, চর্যায় প্রকাশিত ধর্মসাধনাকে ‘বিধিবদ্ধ বৌদ্ধ’ বলা যায়
না কোনোভাবেই। চর্যায় কিন্তু আছে সাধারণ লোক-আয়তনের কথাই। নৌকো বাওয়া, মদ চোঁয়ানো,
চাঙারি বোনা, কাঠ কাটা, তুলো ধোনা প্রভৃতি জীবনের খুঁটিনাটি চর্যায় ফুটেছে। জীবনের
উল্লাস ও অপচয়, রহস্য ও নিরাসক্তি সবই চর্যার বিষয়।
চর্যাপদ প্রসঙ্গে ‘সাহিত্যের কথাই’ যে
সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক, তা হরপ্রসাদ শাস্ত্রী থেকে সুভাষ মুখোপাধ্যায়- সবাই বলেছেন।
এটা ঠিক যে, চর্যা যাঁরা লিখেছিলেন, তাঁদের কাছে প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল কবিতা নির্মাণ
নয়। নিজস্ব, গোপন, জটিল ধর্মীয় আচরণ – পর্যায় এবং তার অনুভব ও দর্শনমালার প্রকাশ।
কিন্তু যদি শুধু তাই হতো, তাহলে চর্যাগুচ্ছ ইতিহাসের নির্বিকার অংশ হয়েই থাকতো, এই
সময়ের মন নিয়ে তাকে ছোঁয়া যেত না। চর্যাপদ যাঁরা রচনা করেছিলেন, তাঁদের শ্রেষ্ঠ
পরিচয় তাঁরা কবি। কবিতার টানেই শেষ পর্যন্ত আরোপিত ধর্ম ও সাধন পদ্ধতির বর্ণনা
অন্য মাত্রার ছোঁয়া পেয়েছে। ফলে কোনো বিশেষ তত্ত্ব বা দর্শনের সীমা পার হয়ে
চর্যাকবি, ক্রমশ তাঁর আলোড়িত চারপাশ থেকে তুলে নিয়েছেন সেই সব প্রত্যক্ষ ও
রক্তমাংসময় ঘটনা, যা, নান্দনিক স্তর-পরম্পরায় হয়ে উঠেছে একটি অমোঘ কবিতার এক-একটি
নিপুণ উপকরণ। তাঁর বিড়ম্বিত মন ও মননের ছায়া ঝুঁকে পড়েছে রচিত কবিতাটির অনিবার্য
অক্ষরে অক্ষরে।
চর্যাপদের খোঁজ পাওয়া বাংলা সাহিত্যে
শিরোধার্য করার মত ঘটনা, সন্দেহ নেই। খুঁজে পাওয়া থেকে সেই পুঁথি ঠিকঠাক পড়া, মানে
নির্ণয়, পুঁথির না পাওয়া অংশ খুঁজে বের করা সহ অনেকদিন ধরে মন ও মনন ব্যবহার করা
প্রক্রিয়ার পরে, আজ, আমাদের অনেকটাই আয়ত্তে বাংলাভাষার গোড়ার কবিতা বইটি। এগুলো
আসলে মহাযান বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সাধনার গান। বৌদ্ধ আচার্যরা বরাবরই সাধারম মানুষের
জন্য ধর্ম প্রচার করেছেন। তাঁদের ভাষাও তাই ছিল সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা। তাঁরা
সংস্কৃতের বদলে প্রাকৃত ভাষাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। মহাযান বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের
সহজযান নামে এক বিশেষ তান্ত্রিক যোগসাধনার প্রচারের জন্য তাই তাঁরা বেছে নিয়েছিলেন
বাংলাকেই। যদিও এখনও পর্যন্ত এ বিষয়ে সবাই-মেনে-নিতে-পারেন এমন কোন সিদ্ধান্ত হয়
নি। চর্যাপদ, তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের ভাবনায় ‘চর্যাগীতি’ যে বাংলাতেই লেখা, কয়েকজন
বাঙালি গবেষকই সেকথা জোর দিয়ে বলছেন, স্বপক্ষে প্রগাঢ় যুক্তি-তথ্য-বিবেচনা নিয়েই।
কিন্তু মুশকিল হল, পাশে অসমীয়া-ওড়িয়া-মৈথিলী ভাষার মানুষজনও যথাসম্ভব বিচার ও
বিশ্লেষণসহই বিশ্বাস করেন যে চর্যাপদ তাঁদের ভাষারই শুরুর কবিতা। রাহুল
সাংকৃত্যায়ন ও কালীপ্রসাদ জয়সওয়ালের মতো বড় পন্ডিতেরা আগাগোড়াই বলেছেন যে চর্যাপদ
তাঁদের ভাষার আওতায়। জয়কান্ত মিশ্রের মতে মৈথিলী।
আসলে চর্যাপদগুলো লেখা হয়েছিল একটু বড়ো ও
নিরাপদ হিসেবে, সুকুমার সেন-মুহম্মদ শহীদুল্লাহ-রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে সাত থেকে
এগারো শতকের মধ্যে। তখনও পর্যন্ত, এমনকি চোদ্দ শতক পর্যন্ত পূর্বভারত
বাংলা-ওড়িয়া-অসমীয়া-মৈথিলী সহ কোনও নতুন আর্যভাষাতেই লিখিত সাহিত্য রচিত হয়েছিল,
এমন প্রমাণ নেই, ওই ভাষাগুলি আলাদা হয়ে ওঠে নি তখনও। ফলে আহমেদ শরীফ বলেছেন সাধনার
গান হিসেবে বহু ব্যবহারের ফলে ও স্থানীয় লোকব্যবহারে চর্যার দুরূহ শৈথিল্য জমা
হয়েছে। সুকুমার সেন ও তারাপদ মুখোপাধ্যায়ও বলেছিলেন, চর্যার ভাষায় নানা উপভাষার
মিশেল আছে। মুহম্মস শহীদুল্লাহের মতে, অন্তত ছজন চর্যাকবির ভাষা বাংলা নয়, কারও
মৈথিলী, কারও ওড়িয়া, কারও ‘বঙ্গ কামরূপী’, কারও অপভ্রংশে ঝুঁকে থাকা।
আহমেদ শরীফ চর্যার বিষয় বিবেচনা করেও
জানিয়েছেন, ‘বাংলা-উড়িষ্যা-আসামের মানুষের জীবন ও জীবিকা পদ্ধতিতে, ভাষা ও
সংস্কৃতিতে’ কোন ‘লক্ষণীয়’ পার্থক্য ছিল না। তাই বাংলার বিশেষ ছাপ যেখানে যেখানে
পেয়েছেন অন্য ভাবুকরা, তা নির্ঘাৎ বাংলারই, এমন কথা বলা অস্বস্তিকর। তবে চর্যার
পুঁথিটি যে বাঙালির লেখা এবং বাঙলা হরফে লেখা, একথা মোটামুটি মেনে নিয়েছেন
দেশী-বিদেশী পন্ডিতরা, তাই এই অঞ্চলেই চর্যার চর্চা বেশি হয়েছিল, একথা ভাবা যেতেই
পারে। সুতরাং ‘বাংলা বুলির’ সংস্কার চর্যাপদে বেশি টের পাওয়া যাবে, এটা তো সত্যিই।
ভাষাতত্ত্বের বিচারে চর্যার বাংলার স্বরাভাস যে সংহত, পন্ডিতদের এই নির্ণয় তাই
অবান্তর নয়।
প্রায় হাজার বছর আগের লেখা, তাই চর্যাপদের
বাংলার সঙ্গে এখনকার বাংলার চোখে পড়ার মত ফারাক। আবার, চেষ্টা করে, এই ভাষার
ব্যবধানটুকু পার হতে গিয়েও আটকে যেতে হবে মোদ্দা বিষয়টাকে ছুঁতে গিয়ে। এর ভাষাকে
‘সন্ধ্যাভাষা’ বলা হয়, হয়তো অস্পষ্টতার সঙ্গে এর মিল আছে বলে। সুভাষ মুখোপাধ্যায়
জানিয়েছেন, ‘চর্যাগীতির এই আলো-আঁধারির দিকটাই আমায় বেশি করে টেনেছে।... পন্ডিতদের
টীকাভাষ্য এড়িয়ে বেহেড, অন্তজ্যদের পাড়ায় আমি কোন গুরুতত্ত্বে নয়, শুধু জীবনরসে
মজেছি’। যদিও বিধুশেখর শাস্ত্রী মনে করেন, ‘সন্ধ্যা’ নয়,
শব্দটি আসলে ‘সন্ধ্যা’। অর্থ ‘আভিপ্রায়িক’, ‘অভিপ্রেত্য’ বা এইরকম। বিতর্ক আছে
চর্যা কথাটির মানে নিয়েও। তিব্বতী ভাষায় ‘চর্যা’ সংস্কৃত ‘আচার’-এর সমার্থক বলে
লিখেছেন কেউ কেউ। কারও কাছে এর অর্থ ‘পাঠ’ বা ‘অধ্যয়ন’। যোগীর ‘আচরণ-ব্যবহার’
অর্থেও ভেবেছেন কেউ।
সংখ্যার বিচারে গুরুত্বপূর্ণ চর্যাকার
তিনজন। কাহ্ন (১৩টি), ভুসুকু (৮টি), সরহ(৪টি)। কিন্তু এভাবে বিচার করা অবান্তর। শবর
বা লুই লিখেছেন দুটি পদ, ঢেন্ঢনপা লিখেছেন একটি। কিন্তু সৌন্দর্যের দাপটে তাদের
দাপট কারও চেয়ে কম নয়। লুই-এর লেখা পদ দুটির ক্রম সংখ্যা ১ ও ২৯। প্রথম চর্যাতে
শরীরের সঙ্গে অনুষঙ্গময় গাছের তুলনা করেছেন তিনি। ক্রমশ, নিজস্ব ধর্মসাধনাগত বিষয়
ফুটে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এক সামগ্রিক কবিতাময়তায় আচ্ছন্ন হয়ে উঠেছে চর্যাটি। ২৯নম্বর
চর্যাতেও ইশারাময় উচ্চারণ তাঁরঃ ‘অনায়ত্ত যার সব, বর্ণ-চিহ্ন-রূপ / আগমবেদের
ব্যাখ্যা সেখানেও চুপ’। কবি হিসেবে লুই-এর যথেষ্ট জোরালো ভূমিকা ছিল চর্যাপদে।
সবচেয়ে বেশি চর্যার কবিঃ কাহ্নপদ। ৭, ৯,
১০, ১১, ১২, ১৩, ১৮, ১৯, ২৪, ৩৬, ৪০, ৪২, ৪৫- এই পদগুলি তাঁর লেখা। কবিতার দ্বিধা
জটিল টানে, ধর্মসাধনার কৌণিক ব্যবহারে তাঁর লেখা আলাদা করে চেনা যায়। কাহ্ন,
কাহ্ন, কাহ্নিল প্রভৃতি নানারকম ভণিতাবিলাস তাঁর আছে। তাঁর ১৮নম্বর চর্যার কামস্বরূপিনী
ডোম্বীর রঙিন বর্ণনা মনে রাখার মত। ভুসুকুর লেখা পদের সংখ্যা ৮, ৬, ২১, ২৩, ২৭,
৩০, ৪১, ৪৩, ৪৯- এই কটি। ২৩ নম্বর চর্যার পুরোটা পাওয়া যায় নি। সব সময়ে নানা
অনুষঙ্গ ব্যবহার করে কবিতা লিখেছেন তিনি। ধর্মীয় প্রসঙ্গের নির্ধারিত গুরুত্ব
সত্ত্বেও অবধারিত কবিতার আভা তাঁর পদে। বিশেষ করে, ৪৯নম্বর চর্যাটি শৌর্য ও
তাৎপর্যে স্মরণীয়, আলাদাভাবেই।
সরহ তাৎপর্যপূর্ণ কবি। ‘কায়কোষ’, ‘অমৃত’,
‘দোঁহাকোষ’ প্রভৃতি তাঁর বই। ‘দোঁহাকোষ’ রচয়িতা হিসেবে সরহ-র আলাদা গৌরব আছে।
তাছাড়াও মরমী চর্যাকবি হিসেবে তিনি শ্রদ্ধেয়। ২২, ৩২, ৩৮, ৩৯ – এই চারটি চর্যা
তাঁর লেখা।
চর্যার অন্য কবিরা হলেন – কুক্কুরীপা (২,
২০।৪৮ নম্বর পদটি শাস্ত্রী মশাইয়ের পুঁথিতে পাওয়া যায় নি), বিরুআ(৩), গুন্ডুরী
(৪), চাটিল(৫), কামলি (৮), ডোম্বী (১৪), শান্তি (১৫,২৬), মহি’আ (১৬), বাণী (১৭), শবর
(২৮, ৫০), আজদেব (৩১), ঢেন্ঢনপা (৩৩), দারিক (৩৪), ভাদে (৩৫), তাড়ক (৩৭), জাঅনন্দি
(৪৬), ধাম (৪৭)।
কয়েকটি চর্যা এখানে
দিলাম –
চর্যাসংখ্যা ১৪
ডোম্বী
গঙ্গা জউনা মাঝেঁ রে বহই নাই।
তহি বুড়িলী মাতঙ্গী পোইআ লীলে পার করেই।।
বাহ তু ডোম্বী বাহ লো ডোম্বী বাটত ভইল উছারা।
সদ্গুরু পাঅপএঁ জাইব পুণু জিণউরা।।
পাঞ্চ কেডুআল পড়ন্তেঁ মাঙ্গে পিট্ত কাচ্ছী বান্ধী।
গঅণ-দুখোলেঁ সিংচহু পাণী ন পইসই সান্ধী।।
চন্দ সূজ্জ দুই চকা সিঠি সংহার পুলিন্দা।
বাম দাহিণ দুই মান ন রেবই বাহু তু চ্ছন্দা।।
কবড়ি ন লেই বোড়ী ন লেই সুচ্ছড়ে পার করেই।
জো রথে চড়িলা বাহবা ন জাবাই কুলে কুল বুড়ই।।
রূপান্তর –
গঙ্গা আর যমুনার ঠিক মাঝখানে
একটি অমোঘ নৌকো, পারাপার জানে
শুধু একজনই, বৃদ্ধা এক, মুগ্ধ শিশুদের
ওপারে পৌঁছে দেয়, ক্রমশ রোদের
তাপ বাড়ে, আবার সে উৎসে ফিরে চলে।
নৌকোর পাঁচটি দাঁড়, যাতে নৌকো কখনও না টলে
ওপরে বেঁধেছে কাছি, সেঁউতিতে অতিরিক্ত জল
সেঁচে ফেলে। চাকায় সূর্য ও চাঁদ। মাস্তুলের বল
গতি ও বিরামে।
কোনওদিনই স্পষ্ট নয়,
তবুও স্বচ্ছন্দ স্রোতে নিজেই তন্ময়
বেয়ে যায়, বিনিময় মানে না, নির্ভুল
তার পথ, যে জানে না, সে শুধু দাপিয়ে চলে কূল।
চর্যাসংখ্যা ১৭
বীণা
সুজ লাউ সসি লাগেলি তান্তী
অণহা দান্ডী চাকি কিঅত অবধূতী।
বাজই অলো সহি হেরুহ বীণা
সুন তান্তি-ধ্বনি বিলসই রুণা।
আলি-কালি বেণি সারি মুণেআ।
গঅবর সমরস সান্ধি গুণিআ।
জবে করহা করহকলে পিচিউ
বতিস তান্তি-ধ্বনি সএল ব্যাপিউ।
নাচন্তি বাজিল গান্তি দেবী
বুদ্ধ-নাটক বিসমা হই।।
রূপান্তর –
সূর্যের গড়ন, আর চাঁদ দিয়ে তৈরি গূঢ় তার।
অনাহত বীণা, তার দন্ড আর চাকির বাহার
অবধূতির মতন।
এই বীণাটি বাজালে অবিরল
শূন্য ভরে যায় শুধু স্বচ্ছ, ছলছল
সুরের মায়ায়।
দুটি রাগঃ আলি-কালি,
মনের সদ্ভাবে জোড়া, এমনকি, খালি
হাতের ছোঁয়ায় ওঠে বত্রিশরাগিণী,
গানে দেবী, নাচে বজ্রধরঃ এই তিথি উচিত কাহিনী।
চর্যাসংখ্যা ১৯
কৃষ্ণ
ভবনির্ব্বাণে পড়হ-মাদলা।
মণ পবন বেণি করন্ড-কসালা।।
জঅ জঅ দুংদুহি-সাদূ উচ্ছলিআঁ।
কাহ্ন ডোম্বী বিবাহে চলিলা।।
ডোম্বী বিবাহিআ অহারিউ জাম।
জঅউতুকে কিঅ আনুণুতু ধাম।।
অহিণিসি সুরঅ-পসঙ্গে জাঅ।
জোইণিজালে রএণি পোহাঅ।।
ডোম্বীএর সঙ্গেঁ জো জোই রত্তো।
খণহ ণ ছাড়অ সহজ-উন্মত্তো।।
রূপান্তর –
প্রণয়প্রয়াসী কাহ্ন, চারপাশে আরম্ভের ম্লান
মাদল, কাঁসি ও অন্য তৈজসের আয়ত উত্থান।
জীবন রঙিন হল, যেন অন্য জীবনের মানে
পেয়েছে সে, এমনকি নিরুত্তর দানে
ঈষৎ আশ্রয়ও।
তারপর প্রিয় শরীরের ভাঁজ
খুলে যায়, মুহূর্তে মুহূর্তে যেন উল্লাসের কাজ
জড়ানো জীবনে। তাকে পেয়েছে যে তার
সর্বাঙ্গে উৎসব; ভরা হৃদয়, সংসার।
(চিত্রঋণ : Rock
Art of the Western Cape, Africa)
চর্যাপদের সিরিজ টা দুর্দান্ত লাগছে । চর্যাপদ এর আগে যদিও পড়েছি । তবে নতুনভাবে বাক এ আবার আলোচনা হওয়াতে বাক কে ধন্যবাদ জানাই ।
ReplyDeleteআর আসল ধন্যবাদ জানাই লেখক সুমন গুন কে ।
রাজবংশী ভাষায় এই শব্দগুলি এখনও অপরিবর্তনীয় ভাবে চর্যাপদের মতোই ব্যবহার করা হয় -
ReplyDeleteচন্দ সূজ্জ ,গুনিয়া ,বাজিল ,সুরঅ পসঙ্গে জাঅ,
ঋণঅ ছারঅ, বাম দাহিণ আরোও কিছু শব্দ
তবে সুমন গুণের অনুবাদ ঠিক অতোটা ভালো লাগেনি
সমৃদ্ধ হলাম।
ReplyDeletewow,,puro khoni,,,pore mon diye porbo abar ,,
ReplyDeleteচর্যাপদের ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন করে দেবার জন্য সম্পাদক অনুপম মুখোপাধ্যায় এবং বিশেষ করে কবি-অধ্যাপক সুমন গুণকে ধন্যবাদ। সুমন গুণ-এর পাণ্ডিত্য আর অতুলনীয় গদ্যভাষার পাশাপাশি পাওয়া গেল প্রাঞ্জল আর নিপুণ কাব্যানুবাদ। নিজেও মৌলিক কবি বলেই এমন স্বচ্ছন্দ অনুবাদ করতে পেরেছেন তিনি। আবারও ধন্যবাদ টিম বাক-এর সবাইকে।
ReplyDeleteদারুণ বিষয়। সুমন কে ধন্যবাদ এমন একটা বিষয় বেছে নেওয়ার জন্য। কিন্তু অনুবাদ গুলো আরও ভালো আশা করেছিলাম।
ReplyDeleteধারাবাহিক... তাই প্রত্যাশা তৈরী হ'ল।
ReplyDeleteবাক্-এর আরও একটি সম্পদ হয়ে থাকবে আশা করি।
অনুবাদের ক্ষেত্রে ভাষা ও সময়ের বহুমাত্রিক পরীক্ষার পরেও স্বতন্ত্র এক-একটা কবিতা হয়ে উঠতে পেরেছে 'রূপান্তর'গুলো। চর্যাগীতি বা চর্যাকবিতাগুলো প্রাথমিক পর্যায়ে মুখে মুখে রচিত, শ্রুত ও বাহিত হত বলেই তাদের মধ্যে রূপান্তরকামী সত্ত্বা অনেক বেশি প্রখর মনে হয়। লিখিত ভাষ্যের রিজিডিটি নিয়ে তারা জন্মায়নি।
ReplyDeleteএখানে অনুবাদ কতটা মূল-অনুসারী হয়েছে এই আলোচনা অহেতুক হলেও সেটা হয়তো এসেই যাবে যেহেতু রূপান্তরের সাথে মূল কবিতাগুলোও রয়েছে। ফলে, অদীক্ষিত পাঠক দুটোকে পাশাপাশি রেখে মেলাতে বসবেই। দুটো কাজকে আলাদা দুটো সময়ের স্বতন্ত্র দুটো কাজ হিসেবে ভাবতে, বা চর্যার সাঙ্গীতিক ইতিহাস মনে রেখে পাঠক এ দুটোকে যুগলবন্দী ভাবতেও যদি পারে, আনন্দ পাব।
ব্যক্তিগতভাবে একটি অনুরোধ। চর্যার প্রায় সমসাময়িক নাথধর্ম। নাথগীতিতেও কাহ্নপা, হাড়িপা-র নাম রয়েছে। প্রায় একই সময়ে হওয়া এই কাজ দুটোতে উপস্থিত থাকা এই কবিদের কাজের ধরন, ভাষা, ইঙ্গিত নিয়েও যদি গদ্যে কিছু কথা রাখেন। এবং আরও একটা দিক, যদিও চর্যাপদের ভাষা ব্যবহারিকভাবে আজ আর নেই। মুখের ভাষা, লেখার ভাষা পালটে আজ বহুদূর। অথচ যে রাগে ওই সঙ্কীর্তনগুলো গাওয়া হত, সেই রাগগুলো প্রায় সবই রয়ে গেছে। নক্ষত্রটা মৃত, তার আলো এসে আমাদের কানে বাজছে।
সমৃদ্ধ হওয়ার বিষয়। বেশ লাগল।
ReplyDelete